ইরা | Era | SUBHOJIT
|| ১ ||
- "হ্যাঁ, এইমাত্র স্টেশনে পৌঁছলাম। ট্রেন ছাড়তে এখনো দেরি আছে। তুমি
চিন্তা কোরো না। ছাড়ার আগে আমি আরেকবার তোমাকে ফোন করবো!", বাবাকে আশ্বস্ত
করে জিৎ ফোনটা পকেটে রাখলো।
এরপর সে এগিয়ে গেলো ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে। প্রয়োজনীয় নথিপত্র
পরীক্ষার পর কলকাতা স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা 'বন্ধন
এক্সপ্রেস' এর জেনারেল সেকেন্ড ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেলো সে। উঠে পড়লো
ট্রেনে। টিকিটটা ভালো ভাবে দেখে নিয়ে তার জন্য নির্দিষ্ট সিটে বসে পড়লো।
জানালার ধারে হওয়াতে জিৎ এর সব দিক থেকে সুবিধা হলো।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুক ভরে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিলো সে। টের পেলো
সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে সে যে উত্তেজনাটা অনুভব করছিলো এতক্ষণে সেটি আকাশ
ছুঁতে চাইছে। এমন সময় তার মনে পড়লো বাবাকে ফোন করতে হবে।
- এইমাত্র ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছাড়তে মিনিট দশেক বাকি আছে।
- ও! কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
- না না।
- আচ্ছা, সাবধানে থাকবে ওখানে। সময় মতো খাওয়া-দাওয়া করবে।
- হুম। তুমিও নিজের খেয়াল রেখো।
ট্রেনের জানালার বাইরে কয়েকটি অকেজো ট্রেনবগির দিকে তাকিয়ে জিৎ ভাবছিল,
ঠিক একই ভাবে প্রত্যেকটি মানব দেহকে নির্দিষ্ট সময় পরে এমনই এক ভগ্নপ্রায়
দায়ে পরিণত হতে হবে, এমনকি নিজেকেও। আর সেই দায় মেটাতে কত মুখোশধারী
ব্যক্তির মুখোশ খুলে পড়বে। কত মানুষ হঠাৎ আবিষ্কার করবে তারাও বিরক্ত। আরও
কত মানুষ নিজেদেরকে ষড়যন্ত্রের মূলচক্রী ভেবে গর্ববোধে বুক বাজাবে।
কিছুক্ষন ধরেই ট্রেনটি তার অস্থিরতা প্রকাশ করছিলো। হাত ঘড়িতে সাত টা দশ
হতেই চলতে শুরু করলো। জানালার বাইরে দৃশ্যগুলো পালটে যেতে লাগলো ধীর থেকে
দ্রুত। অকেজো ট্রেনবগি গুলো হারিয়ে যেতে যেতে হয়তো কিছুটা শুভ কামনা ছুড়ে
দিলো জিৎ এর উদ্দেশ্যে।
|| ২ ||
ফেসবুক নামক অতি জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমে জিৎ এর আলাপ হয় ইরা'র সাথে।
বর্তমানে প্রায় চার বছরেরও বেশি সময়ের বন্ধু ওরা দুজন। ইরা থাকে
বাংলাদেশের খুলনা জেলায়। আর জিৎ চলেছে এই বন্ধুত্বের অবশিষ্ট শুন্যস্থান
পূরন করতে।
প্রায় পাঁচ ঘণ্টার যাত্রাপথে প্রথমে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত - পেট্রাপোল এবং
তারপরেই বাংলাদেশ সীমান্ত - বেনাপোল এ থামার পর অবশেষে বাংলাদেশের খুলনা
স্টেশনে 'বন্ধন এক্সপ্রেস' পৌঁছল ঠিক দুপুর বারোটায়।
ট্রেন থেকে নামার পর স্টেশনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জিৎ বাইরে বেরিয়ে এলো।
রিক্সাতে চেপে দশ মিনিটে হোটেল পৌঁছে গেলো। আগে থেকেই হোটেল রুম বুক করে
রেখেছিলো তাই ফোন থেকে তথ্য দেখিয়ে রুমের চাবি নিয়ে নিলো রিসেপশন থেকে।
এবং নিজের রুম এ চলে গেলো।রুম এর টেলিফোন থেকে জিৎ একটি নম্বরে ফোন করলো।
- হ্যালো। ইরা!
- জিৎ! কখন এসে পৌঁছেছ?
- হ্যাঁ আমি। ট্রেন থেকে নেমেছি বারোটায়। এইমাত্র হোটেলে চেক-ইন করলাম। আজ বিকালে কি করছো?
- আজ বিকালে টিউশন আছে গো।
- ও.. ঠিক আছে। আজ আমি আর ফোন করছি না তাহলে, একেবারে আগামিকাল সকালে করবো।
- ঠিক আছে।
- ওহ ভালো কথা- ইরা, কেমন আছো তুমি?
প্রশ্ন শুনে ইরা হেসে ফেললো।
|| ৩ ||
ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রেখে জিৎ ফ্রেশ হয়ে নিলো। খুব খিদে পেয়েছিল তাই
তাড়াতাড়ি হোটেলের নিজস্ব ক্যান্টিনে গেলো এবং দুপুরের খাওয়া সেরে নিলো।
ইরা'র সাথে কথা বলার পর জিৎ এর শরীরে যেটুকু উত্তেজনা সঞ্চারিত হয়েছিলো
তার থেকেও যাত্রাপথের ক্লান্তি পরিমাণে বেশিই ছিল। তাই খাওয়ার পর অন্য কোনো
দিকে না তাকিয়ে সে রুমে ফিরে এলো এবং সটান শুয়ে পড়লো।
ঘুম ভাঙার পর রুমের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আরো কিছুক্ষণ অবশ হয়ে
বিছানায় পড়ে রইলো। ঘড়িতে সময় এখন আট টা কুড়ি! দেহের অবশ ভাবটা কাটিয়ে
উঠে সে বাথরুমে গেলো, চোখে মুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। আপাততঃ একটু ঘুরতে
বেরোবে সে।
রাতের আকাশ সবসময়ই প্রেমিক মনের সাথে কথা বলে। সুখ এবং দুঃখ উভয় ক্ষেত্রেই।
কখনো লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র দিয়ে মনের মানুষ এর অবয়ব তৈরি করে আবার কখনো
হারিয়ে যেতে যায় অসীমে।
রাস্তার পাশের ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে একটা ফাঁকা বাস স্টপেজ দেখে
সেখানে একটা চেয়ার এ বসলো সে। খোলা আকাশ এর দিকে তাকিয়ে খুঁজতে চাইলো একটা
মুখ। আর মনে মনে বললো-
"তোমার ওই দৃষ্টিতে পথ দেখাও,
আমি হারিয়ে যেতে চাই!
পথ ফুরোনোর বিন্দুতেও থেকো তুমি,
আমি যে তোমাকেই চাই.."
|| ৪ ||
প্রতিদিনের মতো এদিনও জিৎ এর ঘুম ভাঙল অ্যালার্মের শব্দে। তারপর একে একে
কিছুক্ষণ শরীর চর্চা, তারপর ফ্রেশ হয়েই ব্রেকফাস্ট। গতকাল রাত্রে ইরা কে
ফোন করবে ভেবেও করেনি। আজকের প্ল্যানটা দুজন মিলেই ঠিক করতে হবে, তাই সে
ফোন করলো।
- সুপ্রভাত।
- গুড মর্নিং জিৎ।
- কেমন আছো?
- ভালো। আর তুমি?
এই শেষ প্রশ্নটি সবসময় জিৎ কে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। সে প্রতিবার ইরা কে
জিজ্ঞাসা করার পর প্রাণপণে চায় যেনো ফিরতি প্রশ্ন না আসে। কারন সে বুঝতে
পারে না যে কি উত্তর দেবে! যদি উত্তর দেয় 'ভালো আছি' তাও কিছুটা কৃত্রিমতা
লেগেই থাকে গলার স্বরে। উল্টোতে সে খারাপও নেই। কিন্তু আজ উত্তরটা একদম
তৈরি ছিলো।
- বেশ ভালো আছি। বলেই মৃদু হাসলো।
|| ৫ ||
সকালে ফোন রেখে দেওয়ার পর বহুবার রিহের্সাল দিয়ে অবশেষে জিৎ তার হোটেল এর
রুম লক করে, চাবিটি রিসেপশনে জমা রেখে, কিছুটা ঝুঁকি আর একরাশ প্রত্যাশা
বুকে বেঁধে বেরিয়ে পড়লো।
প্রথম দেখার উপহার হিসাবে সে একটি লাল গোলাপ ফুল কিনলো আর সাথে নিলো ইরা'র
অতিপ্রিয় চকোলেট। এরপর অটোতে চেপে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলো সকালে
নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে। কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো সে।
দু-তিন মিনিট পর একটি রিক্সা এসে থামল রেস্টুরেন্টের সামনে। কাচের দরজার
বাইরে জিৎ দেখলো অতি পরিচিত একটা মুখ, চেনা সৌন্দর্যের থেকেও একটু বেশিই
সুন্দর ইরা নামলো রিক্সা থেকে। দরজা দিয়ে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে জিৎ কে
দেখতে পেলো সে।
হাসি মুখে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো ইরা। ততক্ষণে জিৎও উঠে দাঁড়িয়েছে। ইরা
কাছে আসতেই সে লাল গোলাপ আর চকোলেট ওকে দিলো। তারপর দুজনে টেবিল এর দুদিকের
দুটি চেয়ারে বসলো। ইরা ওর কাঁধের ব্যাগটা কোলের উপর রেখে খুললো এবং তার
মধ্যে থেকে একটি ডায়েরি বের করে জিৎ এর দিকে এগিয়ে দিলো। এই ডায়েরি টি আসলে
একটি স্ক্র্যাপ বুক, যেটার প্রতিটি পৃষ্ঠায় খুব সুন্দরভাবে সাজানো আছে
ইরা'র বহু ছবি। এটির আবদার জিৎ আগে থেকেই করে রেখেছিলো। তাই জিৎ এর জন্য
এটি বানিয়ে এনেছে ইরা।
বেশ কিছুটা সময় দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কথা খুঁজে পাচ্ছিলো না। শেষমেশ
বাড়ির কথা দিয়ে আলাপ শুরু হয়ে একে একে অনেক কথা অনেক গল্প এসে পড়লো। ইরা'র
প্রিয় খাবার দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করে ওরা আরো কিছুক্ষন গল্প করলো।
দুজনের নিত্যদিনের কথা, দুজনের ইচ্ছের কথা নতুন ভাবে, আরও কতকিছু।
|| ৬ ||
দুজনের সম্পর্ক অনেক আগেই বন্ধুত্বের সীমানা পার করেছিলো। অনেকবারই
পরস্পরের অনেক কাছাকাছি এসে পড়েছিলো মনের সুড়ঙ্গ দিয়ে কল্পনার মাটিতে। বাকি
যেটুকু ছিলো আজ মানব-মানবী'র এই সাক্ষাতে তাও আর রইলো না।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ওরা একটা রিক্সাতে চড়ে বসলো। পাশাপাশি দুজনের মনের অবস্থা তখন কলমের ভাষার থেকেও অনেক এগিয়ে।
রূপসা ব্রিজের কাছে এসে ওরা রিক্সা থেকে নামলো। তারপর দুজনে নদীর তীর ধরে
হাঁটতে শুরু করলো। নদীর ফুরফুরে হাওয়া ওদের উত্তেজিত হৃদয়ে প্রবেশ করে
যেনো মুহূর্তে শান্ত করে দিলো। হাঁটতে হাঁটতে ইরা'র মুখে এই রূপসা নদীর
কাহিনী শুনতে লাগলো জিৎ।
কথিত আছে যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে 'নড়াইল' জেলার 'ধোন্দা'
গ্রামের 'রূপচাঁদ সাহা' নামক জনৈক লবণ ব্যবসায়ী নৌকায় যাতায়াতের জন্য
'ভৈরব' নদের সঙ্গে 'কাজীবাছা' নদীর সংযোগ করার জন্য একটি খাল খনন করেছিলেন।
সেই 'রূপচাঁদ সাহা'র নাম অনুসারে ঐ খালের নাম হয়েছিলো 'রূপসা'।
পরবর্তীকালে 'ভৈরব' নদের প্রচন্ড প্লাবনে এই ছোটো খাল বিরাট ও ভয়ংকর নদীতে
পরিণত হয় এবং নাম হয় 'রূপসা নদী'।
এই বৃত্তান্ত শোনার পর জিৎ এর মনে পড়ে গেলো 'জীবনানন্দ দাশ' এর লেখা একটি লাইন-
"রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর
এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা বায়.."
|| ৭ ||
দুজনে পাশাপাশি হাঁটার সময় গল্পের মাঝে কখন যে ইরা'র একটি হাত জিৎ এর হাতের
মধ্যে পথ হারিয়েছে তা অনেক পরে আবিষ্কার করলো তারা। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে
চোখ নামিয়ে নিলো দুজনেই। কিন্তু কেউই হাত ছাড়লো না।
ভালোবাসার বাঁধন বড়ই মধুর। বন্ধুত্ব থেকে যে বিশ্বাস এর জন্ম হয়, সেই
বিশ্বাসেই ভালোবাসার বাঁধন তৈরি হয়। এই বাঁধনে একবার আবদ্ধ হলে তা ছিন্ন
করে বেরিয়ে আসা যায় না। বরং বলা যায় কেউই তা চায় না।
রূপসা'র ভরা বুক জুড়ে সন্ধ্যা নামছে। সময় মুহূর্তের সমানুপাতে জানান দিচ্ছে
ফেরার পথ ধরবার। সঙ্গমে আবদ্ধ দুটি মন চাইছে না ফিরে যেতে আবার দৈনন্দিন
বন্দিদশায়। আজ দুজনে উন্মুক্ত আকাশে হারিয়ে যেতে চায় পাখনা মেলে। আজ দুজনে
মিশে যেতে চায় দুজনের হৃদপিন্ডের প্রতিটি শিরার রক্তস্রোতে।
প্রথম দেখার উপসংহারে সময় প্রায় শেষ। দুজনেই ফেরার পথে পা মিলিয়েছে
একসাথে। আজ হেঁটেই ফিরবে বাকি কিছুটা পথ। কিছুক্ষণ পরেই দুটো হাত আলাদা
দুটো পথে ঘরে ফিরবে। দুটো হতে শুধুই লেগে থাকবে পরস্পরের স্পর্শের রেশ।
ভেসে আসবে অজানা সুর-
"আমি আবার ফিরবো
আবার ধরবো এই হাত,
যতোই থাকুক
সীমানার প্রতিটা কাঁটাতারে,
অহংকার!"
© শুভজিৎ
১০ অগস্ট, ২০২০
বি. দ্র. - গল্পটির
প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে মিল নিজ দায়িত্বে খুঁজতেই পারেন।
তবে তার সাথে গল্পটির কোনো যোগসূত্র নেই। গল্পটিকে একটি গল্প হিসাবে গ্রহন
করাই বাঞ্ছনীয়।
😍😍😍😍😍 asa kori golpo ti jeno badtobe mile jai
ReplyDelete